Wednesday 31 August 2016

সুনামগঞ্জ ও আশেপাশের স্পটগুলো ঘুরাঘুরির পুর্ণাঙ্গ গাইডলাইনঃ

সুনামগঞ্জ ও আশেপাশের স্পটগুলো ঘুরাঘুরির পুর্ণাঙ্গ গাইডলাইনঃ

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে অনেককে এই জেলাকে বাংলার কাশ্মীর বলতে শুনেছি, সময় সুযোগ নিয়ে একবার এই জেলা থেকেও ঘুরে আসতে পারেন ।
কখন যাবেন
মুলত সিলেট বিভাগের প্রতিটি জেলা ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল বা বৃষ্টির দিনে। ভরা বর্ষায় ফুটে উঠে হাওরের আসল রুপ সৌন্দর্য। হাওর, লেক আর পাহাড়ি ঝর্ণা/ ছড়া গুলো উপভোগ করতে চাইলে বর্ষাকাল উপযুক্ত সময়, মে-অক্টবর মাস। আর যদি অতিথি পাখির সাথে কাটাতে চান নিরিবিলি সময় তাহলে শিতকাল উপযুক্ত সময়, ডিসেম্বর- মার্চ মাস।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার আরামবাগ/সায়েদাবাদ/চিটাগাংরোড থেকে শ্যামলি,মামুন পরিবহনের বাসে করে যেতে পারেন, এছাড়াও উত্তরা থেকে এনা পরিবহনে করে যাওয়া যায়। ভাড়া ৫৫০ টাকা। এছাড়া সিলেটের বাসে করে সিলেট গিয়েও সুনামগঞ্জের বাসে আশা যায়। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌছাতে মোটামুটি ৫/৬ ঘন্টা সময় লাগে বাসে।
আর যদি সিলেট থেকে আসেন তাহলে মাইক্রো বাস ও লোকাল বাসে করে আসতে পারেন। ভাড়া নিবে ১৫০-১৭০ টাকা।
বারিক্কা টিলার ক্যাম্পিং
কোথায় থাকবেন
সুনামগঞ্জ শহরে রয়েছে বেশ কিছু হোটেল থাকার জন্য। তবে অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভাড়া একটু বেশি মনে হয়েছে আমার কাছে। বাসস্ট্যান্ড এর পাশে কয়েকটি হোটেল আছে- হোতেল নূর, নুরানি,মিজান,প্যালেস। এছাড়াও রয়েছে সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজ। আর যারা টাঙ্গুয়ার হাওর বেড়াবেন তারা ভাড়া করা ত্রলারেই রাত্রি যাপন করতে পারবেন অথবা তাহিরপুর এ উপজেলা পরিষদের বাংলো তে থাকতে পারেন।
যাদুকাটা নদি
কোথায় খাবেন
সুনামগঞ্জ শহরে বেশ কিছু ভালো রেষ্টুরেন্ট আছে সেখানে খাওয়া দাওয়া করতে পারেন। এছাড়া যাদুকাটা নদির পাশে লাউড়েরগর বাজার, বারিক্কা টিলা, তাহির পুরেও মোটামুটি মানের খাবারের হোটেল আছে সেখানেও খেতে পারেন। আর টাঙ্গুয়ার হাওর বেড়ালে বাজার করে ট্রলারের নিয়ে নিবেন মাঝি পাক করে দিবে।
দর্শনীয় স্থান
টাঙ্গুয়ার হাওর
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আর দর্শনিয় অন্যতম বৃহত্তম হাওর হলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর। ভরা বর্ষায় ফুটে উঠে এই হাওরের ভয়াবহ সুন্দর রুপ। আর শিতকালে হয়ে উঠে হাজার রকমের অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য। পাখির চোখে টাঙ্গুয়ার হাওর এর উপ সোন্দর্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। হাওরের কোথাও চোখে পড়বে হরেক রকমের শাপলার মেলা, কখনো নানা গাছগাছিলির অপরুপ সাজ, কখনো মিলবে উত্তাল জলের খেলা কখনো শান্ত হয়ে বয়ে চলা। বর্সুষাকালে সুনামগঞ্জ সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে সরাসরি ট্রলার রিজার্ভ করে যেতে পারেন। এছাড়া লেগুনা বা বাইকে করে টেকেরঘাট গিয়েও ট্রলার রিজার্ভ করে ঘুরে বেড়াতে পারেন। বাইকে বা লেগুনা করে টেকেরঘাট গেলে সময় এবং খরচ কম। সুনামগঞ্জ নতুন ব্রিজের ওপার থেকে বাইকে জনপ্রতি টেকেরঘাট ভাড়া নিবে ১৫০ টাকা আর লেগুনা ৫০-৭০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ৪০-৫০ মিনিট। টেকেরঘাট থেকে এবার সারাদিনের জন্য ট্রলার রিজার্ভ করুন। মাঝি ঘুরিয়ে দেখাবে পুরো হাওর। সারাদিনের জন্য ট্রলার ভাড়া নিবে ২৫০০-২৮০০ টাকা। আর যদি রাত্রে টাঙ্গুয়ার হাওর থাকতে চান তবে ভাড়া নিবে ৩৫০০-৪০০০ টাকা। সেক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ থেকেই বাজার সদাই করে নিবেন। মাঝিরা ট্রলারে রান্না করে দিবে। ট্রলার ভাড়া করার সময় অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
হাছন রাজার বাড়ি
সুনামগঞ্জ সদরেই অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। এখানে হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত আর হাজার তথ্য সমৃদ্ধ একটি মিউজিয়াম ও রয়েছে। শহর থেকে রিক্সা/ইজি বাইক যোগে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন এই জমিদার বাড়িটি।
সুরমা রিভার ভিউ
সুনামগঞ্জ সদরেই সুরমা নদির পাড়ে মনোরম এক পরিবেশে বসে সুরমা নদির রুপ সুধা পান করতে চাইলে একটি বিকেল কাটাতে পারেন এই রিভার ভিউ এলাকায়। সদর থেকে রিক্সা/ইজি বাইকে ১০ টাকা ভাড়ায় সহজেই যাতায়াত করা যায়।
ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরি ও লাল পাহাড়
ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরির জন্য বিখ্যাত সুনামগঞ্জের এই ছাতক উপজেলা। এছাড়াও এখানে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত সিমেন্ট ফেক্তরি লাফাজ। আর এই সিমেন্ত ফ্যাক্টরির পেছনেই রয়েছে ইসলামপুর এর লাল পাহাড়, যেখানে ছুয়ে দিলে মন ছবির স্যুটিং হয়েছিলো। এই পাহাড়ের উপর দাড়ালে ভারতিয় বর্ডার সহ আশপাশ এর প্রকৃতি খুব সহজেই উপভোগ করা যায়। সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক বাস অথবা লেগুনা করে আশা যায়। ছাতক থেকে সুরমা নদি ৫ টাকা দিয়ে পাড় হয়ে ইজি বাইকে করে ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরি যেতে পারেন। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মেইন গেইটের পাশ দিয়ে পিছন দিকে বের হলেই পেয়ে যাবেন সেই লাল পাহাড়।
লাল পাহাড়
যাদুকাটা নদি
ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই যাদুকাটা নদি। এই নদির এক এক সময় এক এক রুপ দেখা যায়। কখনো শান্ত খরা, কখনো ভরা বর্ষায় খরস্রোতা। নদির এপারে লাউড়েরগড় বাজার আর ওপারেই বারিক্কা টিলা। এই নদিতে বেশিরভাগ সময় ই চলে কয়লা আর নুড়ি পাথর উত্তোলন। শিতকালে এর বেশিরভাগ পায়ে হেটেই পাড়ি দেওয়া যায়, আর দূর থেকে মনে হয় যেন বিশাল এক বালুকাময় মরুভূমি। এমন সুন্দর পাহাড়ি নদি দেশে মেলা দুস্কর। সুনামগঞ্জ থেকে মোটর বাইক ৮০ টাকা ভাড়া আর লেগুনাতে ৫০ ৪০ টাকা ভাড়ায় সহজেই আশা যায় এই যাদুকাটার অপরুপ যাদু দেখতে।
বারিক্কা/বারেক টিলা
যাদুকাটা নদির ওপাড়ে উচু যে টিলা বা গ্রাম এর নাম ই বারিক্কা টিলা বা বারেক টিলা। স্থানিয় ভাষায় বারিক্কা টিলা বলেই সবাই ডাকে। এই টিলার উপড়েই রয়েছে সিমান্ত কাটা তারের বেড়া। এর উপড়ে যে পাহাড়্গুলো দেখা যায় পুরোটাই ভারতিয় সিমান্তের মাঘালয়ের অংশ। এই টিলার উপর থেকে যাদুকাটা নদির পাথর আর কয়লা তোলার শতশত নৌকার ভিড় দেখতে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য তৈরি করে। ক্যাম্পিং করার জন্য টিলা পারফেক্ট জায়গা। সকালের সুর্যোদয় দেখার জন্য হতে পারে এই টিলা অন্যতম প্রধান আকর্ষনিয় স্থান। নদির পাশে টিলার নিচে রয়েছে ছোট একটি বাজার সেখানে খাওয়া দাওয়া করার জপ্ন্য রয়েছে দুটি রেস্টুরেন্ট মোটামুটি মানের। তবে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই এই তিলায় ক্যাম্পিং ছাড়া। থাকতে চাইলে চলে যেতে হবে তাহিরপুর বাজারে। সুনামগঞ্জ থেকে মোটর বাইকে করে লাউড়ের গড় বাজার চলে আসুন, ভাড়া ৮০ টাকা। লাউড়েরগড় বাজার থেকে যাদুকাটা নদি ৫ টাকা নিবে পাড়ি দিতে। যাদুকাটা পার হলেই বারিক্কা টিলা।
বারিক্কা/বারেক ছড়া
বারিক্কা টিলায় রয়েছে মিস্টি পানির দুইটি ছড়া। তবে বর্ষা ছাড়া এই ছড়াগুলো প্রায় মৃত থাকে। এই টিলার লোকজন খাবারের পানি ও গোসলের জন্য এই ছড়ার পানি ব্যবহার কর থাকে। বড় ছড়াটি তাহিরপুর যেতে হাতের বা দিকে। যার ঝিড়ি পথ অনেকটা বান্দরবানের ঝিড়ি পথের মত পাথুরে এবং বেশ বড় হয়ে নেমে গেছে টিলা থেকে সমতল জমিতে। চাইলে ঝিড়ি ধরে পুরোটা হেটে ট্রেকিং এর মজাও নিয়ে নিতে পারেন। স্থানিয় যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিবে ছড়া দুটি।
শাহ আরেফিনের মাজার ও ঝর্ণা
এই মাজার টি ভারতিয় সিমানার একবারে নিকটে পড়েছে। যার সাথেই সিমান্ত বেড়ি দেওয়া। লাউড়েরগড় বাজার থেকে মোটর বাইকে ২০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায় এছাড়াও শুকনা মৌসুমে যাদুকাটার পাশ ধরে পায়ে হেটেও যাওয়া যায়। তবে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে দূর থেকে দেখা সব গুলো ঝর্ণার মাঝে এই মাজারের পাশে অবস্থিত ঝর্ণা টি অনেক বড় এবং আমাদের দেশ থেকে সবচেয়ে নিকটে। কিন্তু বর্ষা আর বৃষ্টির দিন ছাড়া এই ঝর্ণা মৃত থাকে। ভরা বর্ষায় এই ঝর্ণার বিশাল আকার আর ভয়াবহ সুন্দর রুপ ধারণ করে। চাইলে বারিক্কা টিলা থেকে নৌকা করেও যেতে পারেন।
টেকেরঘাট চুনা পাথরের লেক
বারিক্কা টিলা থেকে ৬০ টাকা বাইকে ভাড়ায় ঘুরে আসতে পারেন টেকেরঘাট চুনা পাথরের এই অদ্ভুত সুন্দর সবুজ এই লেকটি। এই লেকটি সিমান্তের একদম নিকটে।লেকের শেষ প্রান্তের পাহাড়টি ভারতিয় সিমানায়। চুনা পাথরের একটি পরিত্যক্ত ফেক্টরি রয়েছে এখানে। সাথেই আছে বৃটিশ আমলের রেল। লেকের পানি খুব শিতল এবং গভির এর লেক্টির দুই পাশেই রয়েছে টিলা যেখানে দাঁড়িয়ে লেক কে আরো মনমত উপভোগ করা যায়। চাইলে লেকের পাশে ক্যাম্পিং করতে পারেন। টেকেরঘাট থেকে নৌকা করে টাঙ্গুয়ার হাওর ও ঘুরে বেড়াতে পারেন।
লাকমা ছড়া
টেকেরঘাট বাজারে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিবে লাকমা ছড়ার রাস্তাটি। কিছুদুর হেটে গেলেই পেয়ে যাবেন সিমান্তবর্তি এই অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা লাকমা ছড়াটি। তবে সাবধান সিমানা অতিক্রম করবেন না। কারণ এর বেশিরভাগ অংশই ভারতিয় সিমানায়।
ভ্রমণ পরিকল্পনা
উপড়ে বিস্তারিত সব কিছু খরচ সহ দেওয়াই আছে। নিজেরা গ্রুপ করে একজন কে ম্যানেজার বানিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন বেড়াতে।নুন্যতম ছয়-আট জনের গ্রুপ হলে কম খরচে ঘুরে আসা সম্ভব। রাতের বাসে রওয়ানা দিন, সকালে ভোরেই পৌছে যাবেন সুনামগঞ্জ শহরে। নাস্তা করেই সুরমা ব্রিজের ওপার থেকে বাইকে করে চলে যান লাউড়েরগড় বাজার ভাড়া নিবে ৮০ টাকা। এখানে যাদুকাটা পাড়ি দিয়ে চলে আসুন বারিক্কা টিলা ১০ টাকা দিয়ে। বারিক্কা টিলা থেকে টেকেরঘাট ৬০ টাকা ভাড়া নিবে বাইকে করে চলে আসুন। টেকেরঘাট থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরার জন্য ট্রলার ভাড়া করুন সারাদিনের জন্য,ভাড়া নিবে ২৫০০ টাকা, যারা রাত্রে হাওরে কাটাতে চান তারা পরদিন সকাল পর্যন্ত ভাড়া করুন ভাড়া নিবে ৩৫০০ টাকা। রাতে থাকতে চাইলে সুনামগঞ্জ থেকে বাজার করে নিন। তবে আমার মতে সারাদিনের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে রাতে টেকেরঘাট থাকাই ভালো খরচ কম হবে। টেকেরঘাট থাকার জন্য আছে সরকারি রেষ্ট হাউজ।সকালে লাকমা ছড়া, চুনা পাথরের লেক ঘুরে বাইকে চলে আসুন বারিক্কা টিলা। বারিক্কা টিলা,যাদুকাটা ঘুরে চলে আসুন সুনামগঞ্জ শহরে। বিকেলে হাছন রাজার বাড়ি আর সুরমা রিভার ভিউ ঘুরে রাতের বাসে ব্যাক করুন।
আশেপাশের দর্শনীয় অন্যান্য স্থান- ছাতকের ইংলিশ টিলা
পরামর্শ ও করনীয়
১)গ্রুপ করে গেলে খরচ অনেক কম হবে।
২)ভারী জামা কাপড় না নেওয়াই ভালো। ব্যাগ যত ছোট হবে ঘুরতে ততো মজা লাগবে।
৩)ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে না ফেলে যথাস্থানে ফেলুন। প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ থেকে বিরত থাকুন।
৪)চিপস, চানাচুর, বিস্কুটের প্যাকেট পথে না ফেলে ব্যাগে ভরে নিয়ে আসুন ও যথাস্থানে ফেলুন।
৫)চলার সময় নিরবতার সাথে পথ চলুন। হৈ হুল্লুর থেকে বিরত থাকুন।
৬)সিমান্ত এলাকার খুব কাছাকাছি যাতায়াত ও ক্যাম্পিং এ সাবধানতা অবলম্বন করুন। প্রয়োজনে বিজিবির অনুমতি সাপেক্ষে ক্যাম্পিং করুন।

তথ্যগুলো একত্রিত করেছেন মো: হাবীবুল্লাহ হাসান।
From- ToB Wiki
Photo- From Net