Friday 24 February 2017

কুমিল্লার ময়নামতি : ভ্রমনপ্রেমীদের জন্য অসাধারন একটি স্থান।


কুমিল্লা জেলাশহরের অদূরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান হল ময়নামতি। এ যাবৎ আবিষ্কৃত লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন হল ময়নামতি প্রত্নস্থল। বর্তমানে ময়নামতি অঞ্চলে যে ধ্বংসস্তুপ দেখা যায় তা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীন নগরী ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এটি জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ ।

মধ্যযুগে বৌদ্ধ রাজত্বের রাজধানী ছিল এই স্থানটি। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রাণী ময়নামতির নামানুসারে এই অনুচ্চ পাহাড়ী এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি। কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদশনাদি এখানে অবস্থিত। শালবন বিহার, আনন্দবিহার প্রভৃতি দেশের বৃহত্তম ধ্বংসাবশেষ ময়নামতিতে অবস্থিত। এসব বৌদ্ধবিহারে প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার বহু নিদশনাদি পাওয়া গেছে। ১৯৫৫ সালে এখানে যখন খনন কার্য শুরু হয় তখন এসব নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়াও এখানে জৈন ও হিন্দু দেবদেবীর মূতিও পাওয়া গেছে। এছাড়া এখানকার আবিষ্কৃত প্রত্মতাত্ত্বিক নিদশন সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘরও স্থাপিত হয়েছে। বতমানে ময়নামতিতে একটি সেনানিবাস রয়েছে। যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের একটি যুদ্ধঘাটি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। ময়নামতি ছাড়া এটি লালমাই ও হিলটিয়া নামে পরিচিত।
ময়নামতি প্রত্নস্থলের কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলি হল :
ইটাখোলা মুড়াঃ
বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ময়নামতী অঞ্চলে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধস্থল। এটি কুমিল্লা সদর উপজেলার কোটবাড়ি সড়কের ওপারে রূপবান মুড়ার উল্টোদিকে অবস্থিত। এই প্রত্নস্থান পাহাড়ের গায়ের তিনটি স্তরে বিদ্যমান। প্রাচীনকাল থেকেই এই স্থানটি ইট পোড়ানোর খনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এজন্যই এর এরকম নামকরণ করা হয়েছে।
কোটিলা মুড়াঃ
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তর এর ভীতর অবস্থিত এটি একটি ১২০০ বছর পুরনো প্রত্নত্ত্বাতিক নিদর্শন। স্থানীয়ভাবে প্রত্নস্থানটি কোটিলা মুড়া নামে পরিচিত। খননের ফলে এখানে পাশাপাশি নির্মিত প্রধান তিনটি বৌদ্ধ স্তূপের নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে। এ স্তূপগুলি বৌদ্ধ ধর্মের ত্রি-রত্নের (বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ) প্রতীক। খননে সাত-আট শতকের দু’টি পাথরের মূর্তি, প্রচুর অদগ্ধ সীলমোহর ও নিবেদন স্তূপ এবং শেষ আব্বাসীয় খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহর (১২৮২ – ১২৫৮) একটি স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। ফলে স্থাপনাটি সাত শতক থেকে তের শতক পর্যন্ত কার্যকর ছিল বলা যায়।
শালবন বৌদ্ধ বিহারঃ
শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রত্নস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি এই বৌদ্ধ বিহার । এটি ১২শ প্রত্নতাত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। কোটবাড়িতে বার্ডেরকাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় এ বিহারটির অবস্থান। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এর সন্নিহিত গ্রামটির নাম শালবনপুর। এখনো ছোট একটি বন আছে সেখানে। এ বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো হলেও আকারে ছোট।
রূপবান মুড়াঃ
কুমিল্লার প্রাচীন উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থানসমূহের মধ্যে রূপবান মুড়া অন্যতম। রূপবান মুড়া প্রত্নকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর মনে করে রূপবান মুড়া ৮ম শতাব্দীরও আগে নির্মিত। খননের পর এখানে একটি বিহার, একটি মন্দির, একটি ক্ষুদ্র স্তূপ ও একটি বেদীর স্থাপত্য নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে।
চারপত্র মুড়াঃ
চারপত্র মুড়া ময়নামতীর একটি প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনস্থল। এটি লালমাই শৈলশিরার উত্তরাংশে কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত। এখানে খননের ফলে এক ক্ষুদ্র হিন্দু পীঠস্থান বা মন্দিরের (৪৫.৭ মিক্ম১৬.৮ মি) অস্তিত্ব উদ্ঘাটিত হয়েছে। পরিকল্পনা, আকৃতি, স্থাপত্য ডিজাইন ও অলঙ্করণের দিক থেকে এ মন্দির বিখ্যাত ।
http://assets1.travelobd.com/assets/theme-light/pointer.png
কুমিল্লার শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, আনন্দ বিহার, রানীর বাংলা, ও ভোজ রাজার বাড়ি বিহার খননকালে অনেক মুল্যবান পুরাসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ির শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে শালবনকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
জাদুঘরকে কেন্দ্র করে এরপাশে একটি প্রত্মতত্ত্ব বিভাগীয় বিশ্রামাগার ও মনোরম ফুলের বাগানও গড়ে তোলা হয়।
প্রদর্শনী আধারগুলোতে প্রত্মতাত্ত্বিক স্থান খননের উম্মোচিত স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, ধাতু লিপি ফলক, প্রাচীন মুদ্রা, মৃন্ময় মুদ্রক-মুদ্রিকা, পোড়া মাটির ফলক, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, পাথরের গুটিকা, অলংকারের অংশ এবং ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাড়ি পাতিল প্রদর্শিত হচ্ছে।
এছাড়া আধারের ফাঁকে ফাঁকে মেঝের উপর জাদুঘর ভবনের বিভিন্নস্থানে কিছু পাথর এবং ব্রোঞ্জ মূর্তিও প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এসব মূর্তির কয়েকটি প্রাচীন সমতটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত।
জাদুঘরে প্রদর্শনের উল্লেখযোগ্য পাথর ও ব্রোঞ্জমূর্তি হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের পাথরের দন্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধ মূর্তি, ত্রি বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, হরগৌরীমূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গনেশ মূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরুক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসত্ত্ব মূর্তি।
এছাড়াও ব্রোঞ্জের ছোট-বড় আরও মূর্তি রয়েছে। এ জাদুঘরে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরী বিশালাকায় একটি ঘন্টা। যার ওজন ৫শ’ কেজি। এর ব্যাস ০ দশমিক ৮৪ মিটার এর উপরের বেড়িসহ উচ্চতা ০ দশমিক ৭৪ মিটার।
এ জাদুঘরের আধারে সুরক্ষিত রয়েছে ময়নামতিতে পাওয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা। পোড়ামাটির ফলক। ব্রোঞ্জ ও তামার তৈরী সামগ্রী। লোহার তৈরী সামগ্রী। মাটির তৈরী বিভিন্ন প্রকারের খেলনা। কাঠের কাজের নিদর্শন। তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপির পান্ডুলিপি। বিভিন্ন নমুনার মৃৎপাত্র ইত্যাদি।
যেভাবে যেতে হবে
ঢাকা থেকে কুমিল্লা ৯৬ কিলোমিটারের পথ। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সরাসরি বাস যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে প্রাইম, তিশা, এশিয়া লাইন ইত্যাদি বাসে আপনি সরাসরি যেতে পারেন। বাস ভাড়া জনপ্রতি ১১০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও ফেনীর যে কোনো বাসে চড়েই পৌঁছাতে পারেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত। এখান হতে অটোরিক্সা বা রিক্সায় করে অল্পসময়েই যাওয়া যায় ময়নামতি প্রত্নতত্ত্ব যাদুঘরে।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য কুমিল্লায় বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল চন্দ্রিমা, হোটেল সোনালী, হোটেল, শালবন, হোটেল, নিদ্রাবাগ, আশীক রেস্ট হাউস ইত্যাদি। ভাড়া ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। খাবারের জন্য কুমিল্লা।
যাদুঘর থেকে বার্ড খুব কাছে। বার্ডে যোগাযোগ করলে সেখানেও থাকতে পারেন। তবে ভ্রমন শেষে যাওয়ার সময় কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের পোষাক ও মাতৃভান্ডারের রসমালাই নিয়ে যেতে ভুলবেন না।